সিরাজগঞ্জ:আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সিরাজগঞ্জে যমুনায় জেগে ওঠা চরের বালিতে বাদামের ব্যাপক ফলন হয়েছে। যমুনার চর এখন শস্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন রকমের দানাজাতীয় শস্য। বিস্তৃত চরাঞ্চলের মাটিতে খরচ কম ও ভালো ফলন হওয়ায় হাসি ফুটেছে বাদাম চাষীদের মুখে। যমুনার চরাঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলার এলাকাতেও বাদাম চাষ করা হয়েছে। এ বছর জেলায় পাঁচ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমিতে বাদামের আবাদ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, কামারখন্দ, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালীর ৯টি উপজেলায় পাঁচ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদরে এক হাজার ৩৮২, কাজিপুর ৮৮২, কামারখন্দ সাত, রায়গঞ্জ দুই, তাড়াশ এক, উল্লাপাড়া এক, বেলকুচি ৮৫, শাহজাদপুর ৩৮০ ও চৌহালী উপজেলায় তিন হাজার ৯৭৫ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার মেট্রিক টন।

জানা যায়, নদীর ভাঙনে জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিল। ঠিক সেই সময়ে সিরাজগঞ্জের দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনার শতাধিক চরে এ বছর কৃষি অফিসের  প্রণোদনার মাধ্যমে ১০ কেজি ব্রিজ, ১০ কেজি সার ও ১০ কেজি এমওপি সার পেয়ে এক হাজার চাষি বাদাম চাষ করেছেন। যমুনার বুকে জেগে ওঠা সদর উপজেলার কাওয়াখোলা, নাটুয়ারপাড়া, রেহাইশুড়িবেড়, পানাগাড়ী, চরপানাগাড়ী, তেকানী, খাসরাজবাড়ী, মাজনাবাড়ী, চরছিন্না, চরগিরিশ, রঘুনাথপুর, কাজিপুর সদর, নিশ্চিন্তপুর, শুভগাছা, মাইজবাড়ী, পীরগাছা, সানন্ধা, চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, চরসাফুলা, চরনাগদা, চরঢালা, চরগিরিশ, ঘোড়জান, কোমরপুর, বীরপুর, পীরপুর, চালাকপাড়া, চৌহালীর খাষকাউলিয়া, খাষ রাজবাড়ী, শাহজাদপুরের গালা ও সোনাতনী ইউনিয়নের বড় চামতারা, ছোট চামতারা, কুরশী, বারো পাখিয়া, বাঙালা, রতনদিয়া, জগতলার চর, হাতকোরা, ভেড়াখোলা ও বেনুটিয়ার চরে ব্যাপকহারে বাদামের চাষ হয়েছে। এছাড়া নদীর তীরবর্তী পশ্চিমপাড়ে আরও কিছুসংখ্যক জমিতে এ চাষ হয়ে থাকে।

স্থানীয় বাদামচাষিরা জানান, প্রতি বছর বাদামের বীজ লাগানোর আগে হাল চাষ দিয়ে সামান্য নরম করে দিতে হয় মাটি। তারপর সারি সারি করে লাগানো হয় বাদামবীজ। নদীর চরে প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে পলি জমে মাটি ঊর্বর থাকে। তাই কোনো অতিরিক্তি সার কিংবা কীটনাশক দিতে হয় না জমিতে। চরের মাটি বেলে দো-আঁশ, অধিক তাপমাত্রা ও মাঝারি বৃষ্টিতে দেশীয় জাতের ও চীনা বাদামের ব্যাপক ফলন হয়। কৃষকরা সাধারণত এই দুই জাতের বাদামের চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছে। বাদামের চাষে খরচ কম লাগে, সেচ ও নিড়ানির কোনো প্রয়োজন হয় না। অল্প দিনেই এর ভালো ফলন পেয়ে এবং উৎপাদিত বাদাম বাজারে ভালো দামে বিক্রি করে কৃষকরা হওয়ায় বাদাম চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।

সদর উপজেলার কাওয়াকোলা চরের বাদাম চাষি আক্কাস শেখ বলেন, এবার ৬৬ শতাংশ জমিতে বাদাম চাষ করেছি। এই জমিতে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যে বাদাম হয়েছে তাতে খরচ বাদে ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ হবে। বাদাম ছাড়াও গাছগুলো গো-খাদ্য ও জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এগুলো বিক্রি করে আরও কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যায়।

কাওয়াকোলা ইউনিয়নের গুণেরগাতী চরের কৃষক আব্দুস সালাম, সোলায়মান হোসেন ও আবুল কালাম শেখ বলেন, যমুনার চরে দিনদিন বাদাম চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। এ বিষয়ে চাষিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিলে চাষিরা বাদাম চাষ করতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবেন। এই বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় বাদামের ফলনও ভালো হয়েছে।

শাহজাদপুরের ছোট চামতারা গ্রামের চাষি রহমত আলী বলেন, এ বছর দুই বিঘা জমিতে বাদামের চাষ করেছি। বিঘায় ১২ মণ ফলন পেয়েছি। অন্যান্য ফসলের তুলানায় বাদামে লাভ বেশি। তাই প্রতি বছরই আমি বাদাম চাষ করে থাকি। আগামী বছরে আরও বেশি জমিতে বাদামের চাষ করব।

চৌহালীর খাষকাউলিয়া গ্রামের বাদামচাষি হযরত মিয়া জানান, চলতি মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছি। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আশানুরূপ ফলন পেয়েছি। এ বছর বাদামের বাজারদর ভালো। বর্তমানে শুকনো বাদাম প্রতি মণ চার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাজিপুরের কৃষক আলী হোসেন বলেন, যমুনার চরে বালি-মাটি চীনাবাদাম চাষের জন্য খুবই ভালো। এবার ফলন ভালো হওয়ায় এক বিঘা জমিতে ৯ থেকে ১০ মণ বাদাম পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবছর বাদামের ফলন ভালো হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, জেলায় চলতি বছর পাঁচ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ হয়েছে যমুনার চরে। এই চরের কৃষকরা বাদাম চাষে সফল হওয়ায় প্রতিবছর আবাদ বাড়ছে। এছাড়া আমরা বাদামচাষিদের প্রতিবছর বীজ ও সার দিয়ে থাকি। এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলায় সাড়ে ১০ হাজার মেট্রিক টন ফলন হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।