পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়

“পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয় মরণ একদিন মুছে দিবে সকল রঙিন পরিচয়।” পৃথিবী আগমন নির্গমনের এক পান্থশালা।এখানে আগমন নির্গমন কোনটাকেই বড় করে দেখার বিষয় নয়। পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন পৃথিবীকে আসল ঠিকানা মনে না করে আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহনই মুখ্য বিষয়। মানুষকে পৃথিবী নামক অস্থায়ী ঠিকানায় কিছু সময় বিচরণ করার উপযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যেন অনন্ত জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারে। সূরা আল ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর অবশ্যই কিয়ামতের দিন তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে ।সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে।আর দুনিয়ার জীবন শুধু ধোকার সামগ্রী।” মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। মৃত্যুর পর যদি কোন জীবন না থাকত তাহলে মৃত্যু নিয়ে চিন্তার কারন ছিল না। আসলে মৃত্যু হল দুনিয়ার জীবন থেকে আরেক জগত- অনন্ত জীবনে স্থানান্তরের মাধ্যম। দুনিয়ার জীবন এবং এর সৌন্দর্য ও চাকচিক্য অস্থায়ী। প্রতিটি বসন্তের পরিণামই শরতের মলিনতা এবং প্রত্যেক যৌবনের পরিণামই বার্ধক্য ও মৃত্যু ।জ্ঞানী লোকদের চিন্তা করা উচিত যে, এই পৃথিবী এমন জিনিস নয় যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ আল্লাহ ও আখিরাতকে অস্বীকার করতে পারে, ভুলে যেতে পারে। সূরা আল মুমিনের ৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন ‘হে জাতি দুনিয়ার এই জীবন তো কয়েকদিনের জন্য। একমাত্র আখেরাতই চিরদিনের অবস্থান মহল। অর্থাৎ তোমরা যে এই পৃথিবীর অস্থায়ী ধন সম্পদ ও সুখ স্বাচ্ছন্দে গর্বিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশকে ভুলে যাচ্ছ তা তোমাদের অজ্ঞতা। সূরা হাদীদের ২০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ভালোভাবে জেনে রাখ, দুনিয়ার এই জীবন একটা খেলা, হাসি- তামাশা, চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার এবং সন্তান-সন্ততি ও অর্থ সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উপমা হচ্ছে বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভুষিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে আখিরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আজাব, আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয় ।দুনিয়া এক চলন্ত পথিক, এর উপর ভরসা করা যাবে না।
দুনিয়া মূল্যহীন এক সৃষ্টি। এই দুনিয়া কিছুই না মৃত্যু হবে ঠিকানা আর মাটি হবে বিছানা। আল কুরআনের সূরা তাওবার ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হলো যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো অমনি তোমরা জমিন কামড়ে পড়ে থাকলে। তোমরা কি আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছো। যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখো দুনিয়ার জীবনের এসব সাজ সরঞ্জাম আখিরাতে খুব সামান্য বলে প্রমাণিত হবে আখেরাতে অনন্ত জীবন ও সেখানকার সীমা সংখ্যাহীন সরঞ্জাম দেখার পর তোমরা জানতে পারবে দুনিয়ার সামান্য জীবনকালে সুখ ঐশ্বর্য ভোগের যে সর্বাধিক পরিমাণ সামগ্রি তোমরা লাভ করতে পেরেছিলে তা আখিরাতের সেই সীমাহীন সম্ভাবনা এবং সেই অন্তহীন নেয়ামতে পরিপূর্ণ সুবিশাল রাজ্যের তুলনায় কিছুই নয় ।তখন তোমরা নিজেদের দৃষ্টি ও অদূরদর্শিতার জন্য এমন আফসোস করতে থাকবে যে, এত বোঝানো সত্ত্বেও দুনিয়ার তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী লাভের মোহে তোমরা কেন নিজেদেরকে এই চিরন্তন ও বিপুল পরিমাণ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রাখলে। দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী আখিরাতে কোন কাজে আসবে না ।এখানে যতই ঐশ্বর্য সম্পদ ও সাজ সরঞ্জাম তোমরা সংগ্রহ করো না কেন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথেই সবকিছু থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হবে। মৃত্যুর পর পরপারে যে জগত রয়েছে এখানকার কোন জিনিসই সেখানে তোমাদের সাথে স্থানান্তরিত হবে না। এখানকার জিনিসের যে অংশটুকু তোমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কুরবানি করেছ এবং যে জিনিসকে ভালোবাসার উপর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর ঈমানের প্রতি ভালোবাসা কে প্রাধান্য দিয়েছো একমাত্র সেই অংশই তোমরা সেখানে পেতে পারো। সূরা ইউনুসের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর যেদিন আল্লাহ তাদেরকে একত্র করবেন সেদিন মনে হবে তারা পরস্পরের মধ্যে পরিচয় লাভ এর উদ্দেশ্যে নিছক এক দন্ডের জন্য অবস্থান করছিল প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকে মিথ্যা বলেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা মোটেই সঠিক পথে ছিল না।
আসলেই যখন একদিকে মানুষের সামনে থাকবে আখিরাতের অনন্ত জীবন এবং অন্যদিকে তারা পেছন ফিরে নিজেদের পৃথিবীর জীবনের দিকে তাকাবে যখন তাদের ভবিষ্যতের তুলনায় নিজেদের এ অতীত বড়ই সামান্য মনে হবে সে সময় তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে, তারা নিজেদের পূর্ববর্তী জীবনের সামান্য স্বাদ ও লাভের বিনিময়ে নিজেদের এই চিরন্তন ভবিষ্যৎ নষ্ট করে কত বড় বোকামি করেছে। আল্লাহর সামনে একদিন কপর্দকহীন হয়ে হাজির হবে। সূরা আর রাদ এর ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রিজিক সম্প্রসারিত করেন এবং যাকে চান পরিমিত রিযিক দান করেন। এরা দুনিয়ার জীবনে উল্লাসিত ,অথচ দুনিয়ার জীবন আখেরাতের তুলনায় সামান্য সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয় ।আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ বলেন আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া তুচ্ছ কিছুই নয় অর্থাৎ দুনিয়া এমন যে এটা প্রয়োজনীয় বিষয়ই নয়।
সূরা মুহাম্মদ এর ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “দুনিয়ার এ জীবন তো খেল তামাশা মাত্র। তোমরা যদি ঈমানদার হও এবং তাকওয়ার পথে চলতে থাকো তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের ন্যায্য প্রতিদান অবশ্যই দিবেন আর তিনি তোমাদের সম্পদ চাইবেন না। অর্থাৎ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার অবস্থা কিছু সময়ের মন ভুলানোর চেয়ে অধিক কিছু নয়। এখানকার সফলতা ও বিফলতা সত্যিকার ও স্থায়ী কোন কিছুই নয় যা গুরুত্বের দাবি রাখে। প্রকৃত জীবন হচ্ছে আখেরাতের জীবন। সে জীবনের চূড়ান্ত সফলতার জন্য মানুষের চিন্তা ভাবনা করা উচিত। সূরা আন কাবুতের ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর এ দুনিয়ার জীবন একটি খেলা ও মন ভুলানোর সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল জীবনের গৃহত পরকালীন গৃহ। হায় যদি তারা জানতো! আমরা বাস্তবে দেখলেও এটি এমনই যে এই দুনিয়ার বাস্তবতা হচ্ছে এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য খেলাধুলা করে যার যার গৃহে চলে যাবে। মানবতার জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে চিরস্থায়ী নয়। চিরন্তন নয়।যে যে অবস্থায় আছে সাময়িকভাবে একটি সীমিত ও নির্ধারিত সময়কালের জন্যই আছে। মাত্র এই ক্ষণিক জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এর জন্য ঈমান ও বিবেক বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি প্রতিপত্তির জৌলুস করায় ও করে নেয় তাদের এ সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন তারা যদি একথা জানতো এ দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষার অবকাশ মাত্র এবং মানুষের জন্য আসল জীবন যা চিরকাল স্থায়ী হবে তা হচ্ছে আখিরাতের জীবন। তাহলে তারা এখানে পরীক্ষার সময় কালকে খেলা তামাশায় নষ্ট না করে এর প্রতিটি মুহূর্ত এমন সব কাজে ব্যয় করতো যা সেই চিরন্তন জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট ফলদায়ক হতো। পৃথিবীর দিকে দিকে দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য যুগে যুগে নিজেদের প্রতাপ ও আধিপত্য কায়েমের জন্য পথভ্রষ্টতার নীতি অবলম্বন করে সত্য, ন্যায় সততা ও বিশ্বস্ততার পরিবর্তে এক নৈরাজ্যবাদী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। তাদের ধারণা ব্যবসা-বাণিজ্য রাজনীতি এবং দুনিয়ার অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মিথ্যা বেইমানি এবং দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারে না। প্রত্যেক দুনিয়া পূজারীর মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, দুনিয়ার প্রচলিত পথ থেকে সরে গিয়ে এই জীবন চলতে পারে না। অথচ আল্লাহতা’লা সূরা হুদের ৩নং আয়াতে বলেন ,এবং তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তার দিকে ফিরে আসো। তাহলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দিবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন। তবে যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে একটি অতীব ভয়াবহ আজাবের ভয় করছি। আমরা এভাবে বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তোমাদের দুনিয়ায় অবস্থান করার জন্য যে নির্ধারিত সময় রয়েছে সেই সময় পর্যন্ত তিনি তোমাদের খারাপ ভাবে নয় বরং ভালোভাবেই রাখবেন ।তোমরা তার নেয়ামতে সচ্ছল ও সুখী সমৃদ্ধ থাকবে। যার মাধ্যমে জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। তোমরা লাঞ্ছনা হীনতা ও দীনতার সাথে নয় বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করবে। সূরা নাহলের ৯৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সৎ কাজ করবে সে পুরুষ হোক বা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আল্লাহ তাআলা এ সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও শয়তান প্রত্যেক দুনিয়ার মোহে মুগ্ধ অন্ধ নির্বোধের মনে প্ররোচনা দেয় যে যদি আল্লাহ ভীতি সততা সাধুতা ও পরকালকে গুরুত্ব দিয়ে চলে তবে দুনিয়া বরবাদ হয়ে যাবে, দারিদ্র অভাব অনটনে জীবন বিপন্ন হবে অথচ এই দুনিয়ার উন্নত পর্যায়ের জীবন সামগ্রী যা নিছক দুনিয়ার আয়েশারামের মধ্যে খতম হয়ে যাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতির ভয় কাজ করে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাসাস এর ৫ আয়াতে বলেন, তারা বলে যদি আমরা তোমাদের সাথে হেদায়েতের অনুসরণ করি তাহলে নিজেদের দেশ থেকে আমাদেরকে উৎখাত করে দেওয়া হবে।
আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে বিবেকের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের অন্তরে দিয়েছেন তাওহীদের সত্যতার নিশানী। যতদিন উপায় উপকরণ অনুকূল থাকে ততদিন মানুষ আল্লাহকে ভুলে পার্থিক জীবন নিয়ে অহংকারের মত্ত হয়ে থাকে আর উপায় উপকরণ প্রতিকূল হয়ে গেলে এবং এর সঙ্গে যেসব সহয়ের ভিত্তিতে সে পৃথিবীতে বেঁচে ছিল সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেলে তারপর কষ্ট কট্টরি ক ও নাস্তিকের মনেও শক্ত ধ্বনিতে হতে থাকে যে কার্যকরণের এ সময় জগতের উপর কোন আল্লাহর কর্তৃত্ব পরিব্যপ্ত হয়ে আছে তিনি একক আল্লাহ এবং তিনি শক্তিশালী ও বিজয়ী এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা ইউনূসের ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে বলেন যখন তিনি তাদেরকে বিপদ মুক্ত করেন তখন তারাই সত্য থেকে বিকৃত হয়ে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে বিদ্রোহ করে যাচ্ছে। হে মানুষ তোমাদের এই বিদ্রোহ উল্টো তোমাদের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছে। দুনিয়ায় কয়েকদিনের আরাম আয়েশ ভোগ করে নাও তারপর আমার দিকে তোমাদের ফিরে আসতে হবে। তোমরা কি কাজে লিপ্ত ছিলে তখন তা তোমাদের আমি জানিয়ে দিব। দুনিয়ার এই জীবনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেমন আকাশ থেকে আমি পানি বর্ষণ করালাম তারফলে জমিনের উৎপাদন যা মানুষ ও জীবজন্তু খায়, ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে গেল ।তারপর ঠিক এমন যখন তারা ভরা বসন্তে পৌঁছে গেল এবং ক্ষেতগুলো শস্য সমান হয়ে উঠলো। আর তার মালিকরা মনে করলো এবার তারা এগুলো সব ভোগ করতে সক্ষম হবে। এমন সময় অকস্মাৎ রাতে বা দিনে আমার হুকুম এসে গেল। আমি তাকে এমনভাবে ধ্বংস করলাম যেন কাল সেখানে কিছুই ছিল না ।এভাবে আমি বিশুদ্ধভাবে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করে থাকি তাদের জন্য যারা চিন্তা ভাবনা করে। প্রতিনিয়ত মানুষ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের আল্লাহর শাস্তি গজব ও মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার পরও মানুষ যখন তার জীবন কর্ম প্রচেষ্টার কোলাহলকে শুধুমাত্র এই দুনিয়ার জীবনে সীমাবদ্ধ মনে করে। মৃত্যুর পরও এ দুনিয়ার কর্মকান্ডের কোন হিসাব-নিকাশ বা ফয়সালার শিকার না করে নিজ মনে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তখন তার মধ্যে সত্য-মিথ্যা, শির্ক-বিদআত তাওহীদ-রিসালাত -আখেরাত, পাপ-পূণ্য একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত সত্য তার কাছে কোন নৈতিক মানদন্ডে উপনীত হয় না। তার মৌল আকাঙ্ক্ষা হয় কেবলমাত্র দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সাফল্য। এই দুনিয়ার চিন্তা ও কর্ম পদ্ধতির দরুন শয়তান তার সামনে সব সময় এই দুনিয়াকে একটি শোভনীয় অবস্থায় পেশ করে এবং বিশ্বাস করে যে চমৎকার কাজ করছে। আসলে মানুষ জাগতিক দৃষ্টির কারণে দুনিয়ার সাফল্যে সামান্য ব্যাপারেই বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়। পরকালীন জীবনের প্রতি উদাসীনতা তাকে ইহকালীন বাহ্যিক জীবনের উপর নির্ভরশীলতা, নিজের সমগ্র জীবন পুঁজিকে বাজি রেখে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করে বিপর্যয়ের মুখে নিপতিত হয়ে ইহকালীন ও পরকালীন আযাবের ধ্বংসের অতল গহবরে পতিত হয়। সূরা লোকমানের ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে মানুষ তোমাদের রবের ক্রোধ থেকে সতর্ক হও এবং সেদিনের ভয় কর যেদিন কোন পিতা নিজের পুত্রের পক্ষ থেকে প্রতিদান দেবে না এবং কোন পুত্রই নিজের পিতার পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান দিবে না ।প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। কাজেই এই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে এবং প্রতারক যেন তোমাকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করতে সক্ষম না হয়। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে স্বভাবতই মানুষ নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে আল্লাহর সতর্কীকরণ নির্দেশকেও তামাশার বস্তু বলে মনে করে নিজেদের অর্থ সম্পদ শক্তি ক্ষমতার অহংকারে পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করে চলে। নিজের অজান্তেই তারা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সূরা ইউসুফের ৭ ও ৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এবং পার্থিব জীবনেই পরিতৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত থাকে আর যারা আমার নিদর্শনসমূহ থেকে গাফেল তাদের শেষ আবাস হবে জাহান্নাম এমন সব অসৎ কাজের কর্মফল হিসেবে যেগুলো তারা ক্রমাগতভাবে আহরণ করতো আল্লাহ এখানে বলে দিচ্ছেন যে পরকালীন জীবনের অস্বীকার করার ফল নিশ্চিত জাহান্নাম। এরা এমনই যে এদের দৃষ্টি হল দুনিয়া আর দুনিয়ার সময়টাই তারা পৃথিবীতে বস্তুবাদী ধ্যাণ ধারণার বশবর্তী হয়ে পৃথিবীকে জুলুম নির্যাতন বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা আছে কি। ফাসেকি ও অশ্লীল জীবনচর্চায় ভরে দেয় ফলে দুনিয়ায় তার জন্য পরকালীন কঠিন শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সূরা কাহাফ এর ১০৩ থেকে ১০৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে মুহাম্মদ এদেরকে বল আমি কি তোমাদের বলবো নিজেদের কর্মের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত কারা। এরা তারাই যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম সব সময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থাকবে এবং যারা মনে করত যে তারা সবকিছু সঠিক করে যাচ্ছে এরা এমন সব লোক যারা নিজেদের রবের নিদর্শনাবলী মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার সামনে হাজির হবার ব্যাপারটি বিশ্বাস করেনি তাই তাদের সমস্ত কর্ম নষ্ট হয়ে গেছে। কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হবে না। দুনিয়ার জীবনকেই যারা আসল জীবন মনে করেছে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সাধনা দুনিয়ার জীবনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। দুনিয়ার সাফল্য হওয়ার সচ্ছলতাকে নিজেদের উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে এ ধরনের লোকেরা দুনিয়ায় যতই বড় বড় কৃতিত্ব দেখাক না কেন মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের সেগুলো শেষ হয়ে যাবে। এদের ব্যাপারে সূরা ইব্রাহীমের ৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়, যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং তারা চায় এ পথ বাঁকা হয়ে যাক, ভ্রষ্টতায় এরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে, যারা শুধুমাত্র দুনিয়ার স্বার্থ লাভের কথাই চিন্তা করে বৈশ্বিক স্বাদ লাভ ও আরাম-আয়েশের বিনিময়ে আখেরাতের ক্ষতি কিনে নিতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে থাকতে চায়না এবং আল্লাহর দ্বীনকে নিজেদের ইচ্ছার অনুগত করে রাখতে চায়, আল্লাহর দান তাদের অনুসৃত প্রত্যেকটি রীতিনীতি আচার-আচরণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হোক এরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও শয়তানের অনুসরণে চরম ধৃষ্টতা পূর্ণভাবে সৎ পথ থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্য লোককেও সৎ পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে। সূরা নাহলের ১০৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, এরা এমনই যে যারা আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবন পছন্দ করে নিয়েছে এবং আল্লাহর নিয়ম হল তিনি এমন সব লোককে মুক্তির পথ দেখান না যারা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়। আসলে দুনিয়ার অর্থ সম্পদ সফলতার মাপকাঠি নয়। সূরা যুখরুফ এর ৩২থেকে ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমার রবের রহমত কি এরা বন্টন করে? দুনিয়ার জীবনে এদের জন্য জীবন যাপনের উপায় উপকরণ আমি বন্টন করেছি এবং এদের মধ্য থেকে কিছু লোককে অপর কিছু লোকের উপর অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছি যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে। পারে এরা যে সম্পদ অর্জন করছে তোমার রবের রহমত তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। সমস্ত মানুষ একই পথের অনুসারী হয়ে যাবে যদি এ আশঙ্কা না থাকতো তাহলে যারা দয়াময় আল্লাহর সাথে কুফুরি করে আমি তাদের ঘরের ছাদ ,যে সিঁড়ি দিয়ে তারা বালাখানায় উঠে সেই সিঁড়ি, দরজা সমূহ এবং যে সিংহাসনের উপর তারা বালিশ দিয়ে বসে তা সবই রৌপ্য এবং স্বর্ণের বানিয়ে দিতাম। এগুলো তো শুধু পার্থিব জীবনের উপকরণ। তোমার রবের দরবারে আখিরাত শুধু মুত্তাকিদের জন্য নির্দিষ্ট ।মানুষ দুনিয়ায় যা কিছুই ভোগ করে সবাই মহান আল্লাহর দান আল্লাহর নেয়ামত তাও আল্লাহ সামযয়িক সময়ের জন্যই দিয়ে থাকেন আর নিয়ামত দানে কম-বেশি করার মাধ্যমে পৃথিবী পরিচালনায় শৃঙ্খলা বিধি ঠিক রাখেন। পরকালীন জীবনের সফলতার জন্যই এই দুনিয়া ও দুনিয়ার জীবন। দুনিয়াবি সফলতা তুচ্ছ বৈ কিছুই নয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সতর্কবাণী এবং ঘোষণায় কোন অস্পষ্টতা নেই ।কারণ দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে যারা যে পরিমাণ শক্তি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল বা করবে তার প্রতিটি একটি শ্রেণি মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। মিথ্যার উপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থার ভিত স্থির করে এর ফলে শেষ পর্যন্ত দুনিয়া ও আখেরাতে তারা লাঞ্ছনা শিকার হয় এবং বঞ্চিত হয়। আসলে দুনিয়া তো মানুষের জন্য এমন সব সাজানোর মতো যা একজন মুসাফির তার স্থায়ী বাসস্থানে আগেই পাঠিয়ে দেয় আর স্থায়ী বাসস্থানের সামগ্রী দুনিয়ার চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণকর ও স্থায়ী।
আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছি এবং জীবনের মূল্যবোধকে সজাগ দৃষ্টিতে অবলোকন করছি কিন্তু এসবের ক্ষেত্রে ইসলাম কি ভূমিকা রাখার নির্দেশ দিয়েছে তা জানার আগ্রহ করছি না। অবশ্যই আমাদের উচিত আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী এই দুনিয়ার জীবনকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে চূড়ান্ত মঞ্জিল আখিরাতের সফলতার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা ও সংগ্রাম করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালের মুক্তির মাধ্যমে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন ,আমীন।

আবুল হাসান আল বাহার