সক্ষমতার অর্ধেকও চলছে না রেন্টাল আইপিপি ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো

ইসমাইলআলী: জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। প্রায়ই উৎপাদন নেমে যাচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেকেরও নিচে। তবে সংকটের এ সময়ে দেশের রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলো থেকে খুব একটা সহায়তা পাচ্ছে না সরকার। বরং নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে না পারায় জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে এসব কেন্দ্র। সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না রেন্টাল ও আইপিপিগুলোয়। পাশাপাশি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়েও স্বস্তিতে নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

যদিও দুই সপ্তাহের মধ্যে সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। তবে বর্ষা শুরুর আগে সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখছে না পিডিবি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত জ্বালানি সরবরাহ করা না গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। আর জ্বালানি তেল ও কয়লা আমদানির জন্য ডলার দরকার, যা বর্তমানে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে আমদানিসহ সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট। তবে চলতি মাসের প্রথম আট দিনে এর বড় অংশই অব্যবহƒত থেকেছে। পিক আওয়ারে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য সর্বোচ্চ ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেছে। তবে অফ-পিক আওয়ারে তা ১১ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটেও নেমে গেছে। এতে লোডশেডিং চরমে উঠেছে।

বর্তমানে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৪টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৭২ মেগাওয়াট। আর ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬৫টি, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছয় হাজার ৪৪১ মেগাওয়াট। আদানিসহ কয়লাচালিত কেন্দ্র ৬টি, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। ডিজেলচালিত কেন্দ্র ৮টি, যেগুলোর সক্ষমতা এক হাজার ৪১ মেগাওয়াট। অন-গ্রিড সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১০টি, যেগুলো থেকে আসার কথা ৪৫৯ মেগাওয়াট। একমাত্র জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট এবং আমদানি করা হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।

পিডিবির তথ্য বলছে, চলতি মাসের প্রথম ৮ দিনের মধ্যে ৮ জুন রাত ৮টায় সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সে সময় গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে আসে ছয় হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলের চার হাজার ১৫৪ মেগাওয়াট, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে আসে দুই হাজার ২৯৯ মেগাওয়াট, ডিজেলচালিত কেন্দ্র থেকে ৫৬৮ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ ২৫ মেগাওয়াট এবং আমদানি থেকে এক হাজার ৮২ মেগাওয়াট। রাত হওয়ায় সৌরবিদ্যুৎ কোনো বিদ্যুৎ ওই সময় পাওয়া যায়নি।

এদিকে ৪ জুন সকাল ১০টায় সর্বনি¤œ ১১ হাজার ১৩৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে আসে ছয় হাজার ২৭৫ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলের এক হাজার ৫২৫ মেগাওয়াট, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে আসে এক হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট, ডিজেলচালিত কেন্দ্র থেকে ১০১ মেগাওয়াট, সৌরবিদ্যুৎ ৩৬৮ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ ২৫ মেগাওয়াট এবং আমদানি থেকে এক হাজার ৬৬ মেগাওয়াট।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চলতি মাসে প্রথম ৮ দিনের মধ্যে সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৬০ দশমিক ৭৯ শতাংশ উৎপাদন করা গেছে। আর সর্বনি¤œ উৎপাদন হয়েছে সক্ষমতার ৪৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর মধ্যে চার দফা ভেঙেছে লোডশেডিংয়ের রেকর্ড। প্রথম ৩ জুন রাত ১২টায় তিন হাজার ৮১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এটি ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিংয়ের রেকর্ড।

এক দিনের ব্যবধানে ৫ জুন সে রেকর্ড ভাঙে। এতে ৫ জুন রাত ১টায় লোডশেডিং হয় তিন হাজার ২১৫ মেগাওয়াট। পরের দিন (৬ জুন) বিকাল ৪টায় তিন হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের নতুন রেকর্ড হয়। পরের দিনই তা ভেঙে যায়। ৭ জুন বিকাল ৪টায় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এ সময়গুলোয় চাহিদার ২০ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত লোডশেডিং হয়।

যদিও বৃষ্টির কারণে গতকাল লোডশেডিং থেকে সাময়িক মুক্তি মিলেছে। তবে কতদিন এ অবস্থা থাকবে, তা নিশ্চিত নন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সংকট দ্রুতই কাটার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ কয়লার পর ফার্নেস অয়েলের সংকটেও পড়তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত।

সূত্রমতে, কয়লা সংকটে গত সপ্তাহে বন্ধ গেছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্রটি পুরোদমে চললে এক হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। আবার পরীক্ষামূলকভাবে চালু করলেও কয়লার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় তিন দিন উৎপাদনের পরই বন্ধ হয়ে গেছে এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার। এর একটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৬২০ মেগাওয়াট। তবে তিন দিন ৩০০-৩২০ মেগাওয়াট করে উৎপাদন করা হয়েছে।

এদিকে কয়লা সংকটের কারণে সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করা হচ্ছে বরিশাল ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিতে। কয়লা সংকটে প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিল বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বর্তমানে ১৫০ থেকে ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এ কেন্দ্রে। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটি ইউনিট চালু থাকলেও উৎপাদন হচ্ছে অর্ধেক। অর্থাৎ ৬১২ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিতে ৩০০ থেকে ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে বর্তমানে। এটিও কয়লা সংকটে দুই সপ্তাহ পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

অন্যদিকে বর্তমানে তেল সংকটে ধুঁকছে ৬৫টি ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত বিল পরিশোধ না করায় এসব কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল আমদানিতে এলসি খুলতে পারছেন না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকরা। এছাড়া দেশে ফার্নেস অয়েল মজুত আছে ১৪ দিনের। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলের চালান না এলে ঝুঁকিতে পড়বে এসব কেন্দ্রও।