কুরবানি আল্লাহর একটি বিধান। কুরবানি ইসলামের অন্যতম মহান নিদর্শন। কুরবানি কোন নতুন বিষয় নয়। কুরবানির প্রথা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলমান। সময়ের পরিবর্তনে নবী রাসূলদের আগমনে শরীয়তের হুকুম পালন ভিন্নতর হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে সর্বযুগেই একটি স্বতন্ত্র ইবাদত হিসেবে কুরবানির বিধান চলে আসছে।সূরা হজে ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, কুরবানির নিয়ম প্রতিটি উম্মতের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যেন তারা তাদের পশুর মধ্যে তাদেরকে যে রিজিক দেওয়া হয়েছে তাতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে, আর সেজন্যই কুরবানি একটি বিশ্বজনীন ইবাদত। দুনিয়ার যেখানেই তাওহীদপন্থী কোন মুসলমান আছে সেখানেই একইভাবে কুরবানির পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। আরবি কুরবান শব্দটির অর্থ নৈকট্য। পারিভাষিক অর্থে কুরবানি ওই বিষয়কে বলা হয় যার দ্বারা নৈকট্য হাসিল হয়। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরঈ পদ্ধতিতে যে পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলা হয়। আরবিতে কুরবানি শব্দ ব্যবহৃত হয় না, আল- কুরআনে তিনটি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে কুরবান শব্দ। সূরা ইমরানের ১৮৩ নং আয়াতে, সূরা মায়িদার ২৭নং আয়াতে এবং সূরা আহকাফের ২৮ নং আয়াতে। আমাদের বাংলা ভাষাবাসি মুসলমানগন কুরবানি শব্দটির সাথেই পরিচিত। কুরবানির পিছনে আদম (আঃ) এর পুত্র হাবিল -কাবিল এর দ্বন্দ্ব নিরসনের এক ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ থাকলেও বর্তমানে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত আমরা ইবাদত হিসেবে যে কুরবানী পালন করি তার পেছনে রয়েছে হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ:) এর হৃদয়বিদারক এক করুন কাহিনী এবং ইতিহাসের গৌরবময় শিক্ষণীয় অনেক ঘটনা যা তাকওয়া- পরহেজগারীর নিদর্শন এবং মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে আন্তরিক পরীক্ষার এক নজিরবিহীন কষ্টিপাথর। কুরবানি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। সূরা কাওসারে আল্লাহ বলেন তোমার রবের জন্য সালাত ও কুরবানি করো। সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন..বল, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই জন্য। হাদিসে এসেছে “যে ব্যক্তি সওয়াবের উদ্দেশ্যে আনন্দের সাথে কুরবানি করবে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সে মুক্ত হবে। কুরবানি যেমন সাওয়াব ও ত্যাগের ইবাদত, তেমনি কুরবানিকে অবজ্ঞা করা, সামর্থ্যবান হওয়া সত্বেও কুরবানি না করা নিন্দনীয় অপরাধ ও গুনাহের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কুরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। কুরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ ভীতি অর্জন করা, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। সূরা হজ্জের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে কুরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই আল্লাহ সেগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে করে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো তিনি তোমাদেরকে যে হেদায়েত আল কুরআন দিয়েছেন তার ভিত্তিতে। আর কল্যাণকামী মুহসিনদেরকে সুসংবাদ দাও। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জযবা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ করে আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। এক কথায় কুরবানি শর্তহীন আনুগত্য, তাকওয়া অর্জন, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা এবং স্বীয় স্বার্থ ত্যাগ করার মহান পরীক্ষা। অপরদিকে কুরবানির মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক সহানুভূতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাইতো রাসূল (সা:) বলেছেন, হে লোক সকল! প্রত্যেক পরিবারের উপর কুরবানি করা অপরিহার্য (ইবনে মাজাহ )। রাসূল (সাঃ) নিজেও মদিনায় প্রতিবছর কুরবানি করেছেন। সাহাবীগণ ও নিয়মিত ভাবে কুরবানি করেছেন। অতঃপর অবিরত ভাবে মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণ ধারাবাহিকভাবে কুরবানি পালন করে আসছেন যা কিতাব-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত। বর্তমান সময়ে আমাদের চিন্তার বিকৃতি ও আ’মলের অবনতি এবং চারিত্রিক অধ:গতির এক লজ্জাস্কর পরিণাম হলো মুসলিম সমাজেরই কেউ কেউ দ্বীনের প্রামাণ্য শরীয়ত নির্দেশিত সত্য বুনিয়াদ কুরবানির বিরুদ্ধে বেপরোয়া ভাবে এবং নির্বিকার চিত্তে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস করে। আবার তার সমর্থনে কিছু লোক অগ্রসর হয় অথচ তাদের কাছে দলিল প্রমাণের কোন অস্তিত্ব নেই। এসব প্রতারকরা বলে, স্বাবলম্বী লোকেরা কুরবানি না করলেও চলবে। বলা হয় কুরবানি না করে সেই টাকাগুলো জনকল্যাণ অথবা জাতির উন্নয়নমূলক কোন কাজে ব্যয় করা উচিত। মূলত এখানেই শয়তানের চক্রান্ত কাজ করে, এরা নিতান্তই ভ্রান্ত। আসলে যুগে যুগে নেক সুরতে মুসলিমদের ইবাদতে সন্দেহ প্রবণ করে ধোকা দেওয়ার কাজটি করেছে বর্ণচোরা কিছু মুসলিম। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে কৌশলে ইবাদত থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে কখনো মুনাফিক আর কখনো নাস্তিক মুরতাদরা এই কাজটি করছে। তারা নিজেরা ভ্রান্ত এবং তাদের এ ষড়যন্ত্র শয়তানি চক্রান্তে লিপ্ত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে যথাযথ ভাবে তাঁর ইবাদত করার তৌফিক দিন, আমিন।