লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের অবৈধ ডলার ব্যবসা

১৯ জুন, ২০২৩

লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে অবৈধভাবে ডলার ব্যবসা করছে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা প্রায় শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছেন—যারা লাইসেন্সের অবৈধ ব্যবহার করছে। নামসর্বস্ব একাধিক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ও লাইসেন্স নিয়ে ২৩৫টি প্রতিষ্ঠান মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করে। তবে রাজধানী ঢাকাতেই প্রায় হাজারখানেক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে লাইসেন্সহীন প্রতিষ্ঠানগুলো গাঢাকা দেয়। এ সময় রাজধানীর গুলশান, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় রাজধানীর পাঁচ থানায় পাঁচটি পৃথক মামলাও দায়ের করেছিল সিআইডি।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, অভিযান শুরুর পর অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো রাতারাতি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে গাঢাকা দেয়। কিন্তু সম্প্রতি তারা নতুন কৌশলে আবারও অবৈধ ব্যবসা শুরু করেছে। অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যাতে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া যায়, সেজন্য তারা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এজেন্ট হিসেবে একটি প্রত্যয়নপত্র নিয়েছে।

সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী সর্বোচ্চ দুটি শাখা খুলে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু লাইসেন্সধারী বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন গ্রহণ ও এককালীন অর্থের বিনিময়ে এজেন্টের প্রত্যয়নপত্র বিক্রি করছেন। সিআইডির অনুসন্ধানে এরকম প্রায় একশ’ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুরো বিষয়টি উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয় বা অফিসও নেই। অনেকেই ব্যাগের ভেতরে ডলার নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে থাকে। এ জন্য ডলার স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুধু অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু যারা বৈধ হয়েও লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এটা তারা ভালো বলতে পারবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে, তারা ইতোমধ্যে ৯৭৭টি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূলত কালোবাজার বা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জে কেনাবেচা হলে ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। এছাড়া দেশে বৈধ এক্সচেঞ্জের চেয়ে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জে বেশি ডলার কেনাবেচা হয়। এ জন্য দেশে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে প্রতিদিন কালোবাজারে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ডলার বেচাকেনা হয়। এটি বন্ধ করতে পারলে রিজার্ভ বাড়ার পাশাপাশি ডলারের দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো।

বাংলাদেশ মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তারা সবসময় সহায়তা করে আসছেন। আগে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সংগঠনের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া লাইসেন্স নবায়ন না করার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এখন বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদারকি করতে পারবে অ্যাসোসিয়েশন।

মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের একজন দায়িত্বশীল নেতা ও ঢাকার একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী জানান, সাম্প্রতিক অভিযানে ৫-৬টি বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়ায় তাদের লাইসেন্স স্থগিত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর তারা আর কখনও অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না, এমন মুচলেকায় তাদের স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়েছে।

মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি ও গ্লোরী মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের কর্ণধার এ কে এম ইসমাইল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে অ্যাসোসিয়েশনের কোনও ক্ষমতা ছিল না। এখন আমরা বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিয়মিত তদারকি করবো। কেউ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেও অভিযোগ জানাতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘কালোবাজারে ডলার বেচাকেনা বন্ধ করলে ডলারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করে আসছি। নিয়মিত বৈঠক করছি। সংগঠনের কোনও সদস্য যদি অবৈধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, তাহলে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না। তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’