কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনার ভাগাড়
প্রকাশঃ সোমবার ১৯ জুন, ২০২৩
ফরিদপুরের কুমার নদে তিন দশক আগেও ছিল টলটলে জল। এক সময়ের তীব্র স্রোতধারার এ নদ দখল-দূষণে এখন মৃতপ্রায়। নদের এ পরিবর্তন চোখের সামনেই দেখেছেন ফরিদপুর সদরের বিলমামুদপুরের গৃহবধূ মিয়া খাতুন। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয় তখন ফিরছিলেন নদের দূষিত নোংরা কালো জলে গোসল শেষে। আক্ষেপ করে বললেন, ‘৩০ বছর আগে বিয়ে হয় আমার। নদীর পাড়ে শ্বশুরবাড়ি। যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ি এলাম তখন কী যে খুশি হয়েছি। বাড়ির পাশ দিয়া বড় বড় লাও (নৌকা) চলত। উঠানে বসে পাল তোলা লাওয়ের দিকে চেয়ে থাকতাম। গোসল, নাওয়া-খাওয়ার সব ব্যবস্থা ছিল এই নদ। এখন পানি মুখেও নেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে গোসল করি। এরপর শরীর চুলকাতে থাকে।’
মিয়া খাতুনের বর্ণনার সেই কুমার নদ এখন চিন্তা করাও কঠিন। পুরো নদ ভরে গেছে কচুরিপানায়। ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো এই নদের পানিও দূষণে যেন আলকাতরা। সর্পিলাকার এই নদ ফরিদপুর শহর ও আশপাশের যেসব জনপদের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সেখানে দূষিত পানির গন্ধ।
যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে শহর ও গৃহস্থালি বর্জ্য। এ যেন এক আবর্জনার ভাগাড়। দখল-দূষণে মৃতপ্রায় এমন নদের চিত্রই দেখা মেলে সরেজমিন।কুমার নদের পাশের এলাকা সমেশপুর। এখানকার বাসিন্দা কোহিনূর বেগমের কণ্ঠেও ঝরল কষ্ট। তিনি বলেন, ‘আগে এই নদের পানি দিয়ে ভাত রান্না করে খেয়েছি। এখন নদীর পাশে বাড়ি হলেও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পচা পানির গন্ধে ঘরেও টেকা যায় না। অপেক্ষা করি কখন বৃষ্টি নামবে। নদে পানি একটু বাড়লে গন্ধ সামান্য কমে। টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন বেশি। তাই বাধ্য হয়ে এখনও পচা পানিতে শরীর ভেজাতে হয়।’
কুমার নদের শুরু পদ্মা থেকে। ফরিদপুর সদর উপজেলার মদনখালী এলাকা থেকে গোপালগঞ্জের সেনদিয়া ঘাট পর্যন্ত এই নদ বিস্তৃত। দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। ফরিদপুর সদর, নগরকান্দা, সালথা, বোয়ালমারী, মধুখালী ও ভাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এটি। এর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে ফরিদপুর শহর।
ফরিদপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য অমিত মনোয়ার বলেন, শহরের সব আবর্জনা কুমার নদে পড়ছে। এতে গভীরতা কমে গেছে। পুনর্খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কয়েক মাস খনন চলার পর এখন পুরোপুরি বন্ধ।
সরেজমিন দেখা যায়, বাজার ও বাসাবাড়ির যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। রান্নাঘরের আবর্জনা ছাড়াও রয়েছে কার্টন, পলিথিন এমনকি পয়ঃবর্জ্য পর্যন্ত। শহরের হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারের পাশে ড্রেন দিয়ে আসছে নোংরা পানি। দুটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্যও এসে পড়ছে এ নদে। রথখোলার বাসিন্দা সুকুমার নাথ বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আমাদের বলেছিলেন, এই নদীর পাড় হাতিরঝিলের মতো করে দেবেন। তার কিছুই আমরা পেলাম না।
নদের দুই পাড় যেন ক্রমেই দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। পাড়ের জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা তুলছেন ঘর। দিনে দিনে বাড়ছে দখলের প্রতিযোগিতা। পুনর্খননের সময় শহরের প্রান্তে নদের উৎসমুখের কাছে চুনাঘাটা হতে অম্বিকাপুর পর্যন্ত পাড় দখলমুক্ত হলেও ফের তা বেদখল হচ্ছে। নদীর পাড়ে ঘর তুলে মুরগির খামার করে চলছে পরিবেশ দূষণ। এ ছাড়া শহরের মধ্যেও দুই পাড়ে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা।
ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শিপ্রা গোস্বামী বলেন, কুমার নদ খননের প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। তবে নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। পৌরসভার সব ড্রেন ও নালা এসে পড়েছে নদীর বুকে। কুমার নদকে বাঁচাতে হবে।
ফরিদপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মনিরুল ইসলাম বলেন, কুমার নদে আগে অনেক স্রোতধারা ছিল। বাজারের ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। যদিও বর্জ্য না ফেলার জন্য আমরা নদীর পাড়ে সাইনবোর্ড টানিয়েছি। শহরের ড্রেনের মুখগুলোর বিকল্প পথ খুঁজে বের করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বলে জানান তিনি।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, নদের পাড়ে বিভিন্ন অবকাঠামো থাকায় শহরের ভেতরে দুই কিলোমিটার পুনর্খনন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখানে নদীর যে নাব্য থাকার কথা তা রয়েছে।
নাব্য ফিরিয়ে আনতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৮ সালে কুমার নদ পুনর্খনন ও ৬১টি পাকা ঘাট নির্মাণের কাজ শুরু করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদে ১০ কোটি ঘনমিটার পানিপ্রবাহের মাধ্যমে ২৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধায় আনার কথা ছিল। এতে ৩৪ হাজার ১০৪ টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের আশা করা হয়েছিল। তবে অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা অপসারণ করতে না পারায় নদ আর পুনর্খনন করা যায়নি।
এদিকে ১ জুন কুমার নদসহ ফরিদপুরের সব নদনদীর কচুরিপানা পরিষ্কারের লক্ষ্যে এক প্রস্তুতি সভা হয়। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার সভাপতিত্বে সভায় জানানো হয়, ১৭ জুন থেকে ফরিদপুরের কুমার নদে স্বেচ্ছাশ্রমে কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযান শুরু হবে। পুরোপুরি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।