প্রকাশঃ সোমবার ১৯ জুন, ২০২৩
সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পুরোপুরি সুবিধা নিতে চায় জামায়াতে ইসলামী। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাচ্ছে দলটি। ভিসানীতির সুবিধা নিয়ে গত ১০ জুন দীর্ঘ দশ বছর পর রাজধানীতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে দলটি। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন তালিকায় দলটির নাম পুনরায় অন্তর্ভুক্তি করা এবং রাজধানী ঢাকার মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় চালু করতে চায় জামায়াত। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ দাবি আদায় হলেই কেবল জামায়াত আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, ‘আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না জামায়াত। আমরা নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছি; এই দাবি পূরণ হলেই কেবল আমরা নির্বাচনে যাব।’
এদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত তাদের শতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করেছে। আরও প্রার্থী ঠিক করতে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ করছেন বলে জামায়াত সূত্রে জানা গেছে। আবদুল হালিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে তাদের মনোনয়ন বোর্ড দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করে থাকে। কিন্তু জামায়াতের প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়টি ভিন্ন। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে এক থেকে দুই বছর আগে জামায়াত তার প্রার্থী চূড়ান্ত করে। বিগত নির্বাচনগুলোতেও তাই হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত দেশের শতাধিক আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে।
এক দশক ধরে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওই বিষয়গুলোকেই এত দিন যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। কিন্তু এখন মন্ত্রীরা জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেন, গত এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা অস্বস্তিতে ছিলেন। গত ১০ জুন সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে তাদের সেই অস্বস্তি কিছুটা কেটে গেছে।
এই অবস্থায় জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল নিয়ে একটি জোট হতে পারে বলে গুঞ্জন আছে। এ প্রসঙ্গে আবদুল হালিম বলেন, জোট করা নিয়ে আলোচনা আছে; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেই। আমরা মনে করি জোট গঠনের চেয়ে মাঠের ঐক্যটাই জরুরি।
যদিও জামায়াতের ১০ জুনের সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা সন্দেহ ও সরকারের নমনীয়তা প্রকাশসহ নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। মাঠের বিরোধী দল বিএনপির কারও কারও সন্দেহ, সরকারের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হয়তো জামায়াত নতুন করে মাঠে নেমেছে। সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্যের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
সমাবেশের পরের দিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, জামায়াতে ইসলামী যেহেতু নিষিদ্ধ দল নয়, তাই তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
যদিও গত ১২ জুন এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, এত দিন কেন সমাবেশ করতে পারেনি, সেটা প্রশ্ন হতে পারে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে সরকার জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, গত ১০ জুনের সমাবেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ অবহিত ছিল। সে কারণে সরকার অনুমতি দিয়েছে।
জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, গত এক যুগে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দল কখনো যদি ভুল করেও এমন সিদ্ধান্ত নেয়; তা হলে নির্যাতিত পরিবারগুলোর কাছ থেকে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা কোনো অবস্থায় ছাড় পাবেন না।
দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, দেশে তো আরও রাজনৈতিক দল আছে। তারাও তো সরকারের অনুমতি নিয়ে কর্মসূচি করে। জামায়াতও তাই করেছে। তা হলে কী বলবেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সমাঝোতা করে কর্মসূচি করছে।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপি যখন যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা দাবি দিয়েছিল, তখন জামায়াতও আলাদাভাবে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছিল। সে সময় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো তিনি জেলে রয়েছেন। জামায়াত শুরুতে যুগপৎ আন্দোলনেও ছিল; আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে আলাপ না করা এবং নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে প্রতিবাদ জানিয়ে কোনো বিবৃতি না দেওয়াসহ বেশ কিছু কারণে যুগপৎ আন্দোলন থেকে ঘোষণা ছাড়াই নিজেদের সরিয়ে নেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
জামায়াত নেতাদের দাবি, সরকার কৌশলে হেরে এবং পরিস্থিতির ফেরে পড়ে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, গত ১০ জুন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে আমরা দেশে-বিদেশে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছি। এখন আমরা জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পেতে রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াইয়ে আছি। আমাদের বন্ধ করে দেওয়া কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের দলীয় কার্যালয় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে দুই মাস সময় দেন। ওই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী ও দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আদালত দুই মাসের জন্য সময় দিয়েছেন। এ দুই মাসের মধ্যে কনসাইজ স্টেটমেন্ট (আপিলের সার সংক্ষেপ) জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আর কোনো সময় দেবেন না বলেও উল্লেখ করেছেন।
জামায়াতের অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক বলেন, আদালতের নির্দেশনা মেনে আমরা গত ২২ মার্চ সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছি। জামায়াতের অপর একজন আইনজীবী বলেন, আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠলে এই নিয়ে শুনানি হতে পারে।