হজ্জ : বিশ্ব ইসলামী প্রতিনিধি সম্মেলন

আবুল হাসান আল বাহার
ইসলাম বিশ্ব মানবতার একমাত্র ভারসাম্যপূর্ণ আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলিক স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ হচ্ছে হজ বা বায়তুল্লার জিয়ারত। ইসলামী শরীয়তের নির্দেশিত নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কা’বা ঘরকে কেন্দ্র করে আরাফাতের মাঠে উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত নিয়মে কিছু অনুষ্ঠান পালন করাকে হজ বুঝায়। সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্য থেকে যারা কাবা ঘরে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তারা যেন আল্লাহর জন্য এই ঘরের হজ সম্পন্ন করে।
হজ একটি ফরজ ইবাদত। হজ্ব ফরজ এ ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। তথাপিও নানান অজুহাতে অনেকে এ ফরজ আদায় করা থেকে বঞ্চিত থাকি। হজের অস্বীকারকারী মুসলিম থাকতে পারে না। হজ মুসলমানদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি করে। হাজীগণ আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তাঁর বাড়িতে হাজিদের ডেকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর মেহমান হওয়ার যোগ্য বানিয়েছেন। আল্লাহর নেয়ামত ও মর্যাদা লাভের জন্য তার বাড়ি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর বায়তুল্লাহ হাজিদের মঞ্জিল। হাজিদের জন্য আল্লাহর দিদার নিকটবর্তী।
হজের মাধ্যমে তাওহীদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়। তাওহীদ তথা এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত অসংখ্য আল্লাহর নবী ও রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন। তাওহীদে বিশ্বাস মানুষের আত্মসচেতনতা ও আত্ম মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলে। এ বিশ্বাস সব বিভেদ ভুলিয়ে সকল সৃষ্টির মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে।
হজ আল্লাহর জন্য, আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হওয়া অপরিহার্য। কোন ব্যক্তি বা বস্তুর স্বার্থ অথবা লোক দেখানো প্রচারমুখ হজ করা বৈধ নয়। সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “তোমরা আল্লাহর জন্যই হজ ও ওমরা পালন করো।” হজের মাধ্যমে একজন মুসলিম তার কু-প্রবৃত্তি দমন ও মানসিকতাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে সক্ষম হয়। তার মাঝে শয়তানের প্ররোচনা মুক্ত আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি হয়। তার আত্মাকে প্রসিদ্ধ করতে পারে। সূরা হজের ৩২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,” যারা আল্লাহর নির্দেশনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এটা তাদের অন্তরসমূহের তাকওয়ারই লক্ষণ। “
হজের মূল কর্মসূচি হচ্ছে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে অবস্থান করা অর্থাৎ জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে মূলত হজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হজ হচ্ছে আরাফাতে অবস্থান করা। অতএব যে ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থান করেছে সে হজ পেয়েছে। আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরায় দাঁড়িয়ে মুসলিম উম্মার ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব মানবতাকে শান্তি কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির মোহনা ইসলামে প্রবেশের উদাত্ত আহ্বান জানানোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করা হয় আমরা সবাই মুসলিম। ইসলামী শরিয়া পালন আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। মানুষ হিসেবে ভাষা অঞ্চল ও বর্ণের পার্থক্য থাকলেও মুসলিম মিল্লাতের সদস্য হিসেবে আমরা সকলে এক জাতি, এক দেহ, ঐক্যবদ্ধ। বর্তমান দুনিয়ায় ফিতনা-ফাসাদের এই শয়তানি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শয়তানের চক্রান্ত নস্যাৎ করতে মুসলিম উম্মার ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন “তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়ভাবে আল্লাহর রজ্জু ইসলামকে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না( আল ইমরান ১০৩)।
মূলত হজ শারীরিক ও আর্থিক সমন্বিত এক ইবাদত। একজন হজ পালনকারী মুসলিম আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সম্পদের লোভ-লালসা ত্যাগ করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকে। যার মাধ্যমে সে কুপ্রবৃত্তি দমন ও আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে থাকে। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে আরাফার সম্মিলিত মহিমান্বিত সমাবেশে ঐক্যবদ্ধভাবে শয়তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে গুনাহমুক্ত হয়ে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ আল কুরআনে বলেন , হজের জন্য ফয়সালা কৃত ব্যক্তি যেন হজের সময় যৌনক্রিয়া, পাপকর্ম করা এবং ঝগড়া বিবাদ করা থেকে বিরত থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কা’বায় হজ করে এবং এ সময় যৌনক্রিয়া এবং গুনাহের কাজ না করে তাহলে সে মায়ের গর্ভ হতে জন্ম লাভ কালের মত নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।
হজকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বিজয় উৎসবে পরিণত করতে হবে। ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের ব্যবধান মুছে পরিণত করতে হবে তাওহীদবাদী ঐক্যবদ্ধ মুসলিম হিসেবে। ইহরামের সাদা পোশাকে লক্ষ লক্ষ তাওহীদবাদি আল্লাহর বান্দাদের ভাব গাম্ভীর্য ময় লাব্বাইক ধ্বনিতে পৃথিবীকে করতে হবে প্রকম্পিত। হজের এ মুসলিম মহামিলনের কেন্দ্র কা’বায় লাব্বাইক বলে হাজির হয়ে শিরক এর বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে মুসলিম ব্যক্তি হজ সমাপন করে নিজ নিজ অবস্থান স্থল মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তাগুত, কুফরি শক্তিকে শিরকের মহাসংকট থেকে মুক্ত করে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এটাই হজের মৌলিক দাবি।
পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুসলিমগণ প্রতি বছর হজের সম্মেলন থেকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েই দেশে ফেরা দরকার। মদিনায় রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বে সংগঠিত জাতির নজিরবিহীন ঐক্যের ফলেই সারা পৃথিবীতে ইসলামের সংস্কৃতি তাহজিব তামুদ্দুন প্রচার করে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিচ্ছি ১। একতাবদ্ধ ভাবে জীবন যাপন করবে ২। নেতার নির্দেশ মানবে ৩। নেতার আনুগত্য প্রকাশ করবে ৪। প্রয়োজনে হিজরত করবে ৫। আল্লাহর পথে জিহাদ করবে (তিরমিজি)।
বিশ্ব মুসলিম মানবতাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করা একান্ত কর্তব্য। তা না হলে মুসলিম উম্মাহ দুর্বল হয়ে পড়বে এবং কাফের মুশরিকদের রোষানালে থাকবে। আল্লাহ বলেন, তোমরা পরস্পর বিবাদ করবে না তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে (সূরা আনফাল- ৪৬) । হজকে শুধুমাত্র কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয় বরং হজকে মৌলিকভাবে বিশ্ব মুসলিম উম্মার আন্তর্জাতিক একটি প্রতিনিধি সম্মেলন হিসেবে অর্থবহ করে তুলতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হজ পালনকারী ব্যক্তিগণ হজের এই মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ইসলামের মহান বাণী আল কুরআনের শিক্ষা নিয়ে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে। হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা কা’বা ঘরকে কেন্দ্র করেই পালন করতে হয়। মক্কায় কা’বাঘর পৃথিবীর প্রাচীনতম ঘর। এটি পৃথিবীর বুকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। এই ঘরই মুসলিম মিল্লাতের কিবলা ও মিলন কেন্দ্র। হজের সফরে এই ঘরে উপস্থিত সকলে যখন একই পোশাক, একই ভাষায় ও একইভাবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে তখন তারা ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের এক অপূর্ব শিহরণ অনুভব করে। আগত মুসলিমগণ পরস্পর একে অপরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আলিঙ্গন করে পরিচিত হয় আপন হৃদয়ে। জান্নাতি এক আবেগ উচ্ছ্বাসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে ধ্বনি দিয়ে বলে ওঠে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক- আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির। হে আমাদের রব আমাদের এ কাজ কবুল করুন নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা সর্ব জ্ঞানী। মক্কার অভ্যন্তরে কা’বা -মিনা -আরাফা -মুজদালিফার প্রান্তরে হাজীদের লাব্বাইক ধ্বনী চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হলে আমার হৃদয় মন উৎসাহবোধ করে, আকর্ষিত হয়। মনে হয় যেন আমি সেখানেই উপস্থিত।হে আল্লাহ আমাদের সকলকেও তোমার ঘরের মেহমান হিসেবে কবুল করো। আমাদেরকেও আরাফার মাঠের এই মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তাকবীর ধ্বনি করার সুযোগ দাও “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা- শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা অননিঅমাতা লাকা ওয়াল মুলক,লা- শারীকালাক। আমিন।